স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া রোগ থেকে মুক্তির উপায়
স্ক্যাবিস কে খুজলি বা পাঁচড়া বলা হয়ে থাকে, এটি একটি চর্মরোগ। সহজ কথায় যখন কোন হিউম্যান বডি বা ব্যক্তি (সারকপটিস স্ক্যাবিই) মাইটস দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তাকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় স্ক্যাবিস।
পেজ সূচিপত্র ঃ
স্ক্যাবিস কি
স্ক্যাবিস এক প্রকার চর্মজনিত রোগ। অনেকে একে খুজলি বা পাঁচড়া হিসেবেও চিনে থাকে। সারকপটিস স্ক্যাবিই (আট পা যুক্ত পোকা) মাইট দ্বারা সংঘটিত এক ধরনের পরজীবীর আক্রমণে এই রোগ দেখা দেয়। এই পোকাটি এতই ছোট যে খালি চোখে দেখা যায় না। এটিকে দেখার জন্য মাইক্রোস্কোপের প্রয়োজন হয়। এরা মানুষের ত্বককে প্রজননতন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। ত্বকের নিচে প্রবেশ করে ডিম পাড়ে।
প্রতিদিন দুইটা থেকে তিনটা করে ডিম পাড়ে এবং এভাবে চার থেকে ছয় সপ্তাহ পর্যন্ত ডিম পাড়তে থাকে তারপর পোকাটি মারা যায়। তারপর আবার ওই ডিমগুলো থেকে নতুন পোকা জন্ম নেয়। ত্বকের নিচে যে জায়গা গুলিতে ডিম পাড়ে সেই জায়গা গুলি থেকেই শুরু হয় চুলকানির। স্ক্যাবিস হলে প্রচন্ড শরীর চুলকায়। এজন্য কেউ কেউ একে চুলকানি রোগ বলেও জানে। সাধারণত রাত্রিতে এর চুলকানি বেশি দেখা যায়।
সঠিক সময় এ রোগের সঠিক চিকিৎসা না হলে কিডনি এবং হৃদযন্ত্রের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এটি একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। পরিবারের একজনার এই রোগ হলে অন্য জনদের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি থাকে। স্ক্যাবিস দুই প্রকারের হয়ে থাকে। একটি হলো ক্লাসিক স্ক্যাবিস। আর অন্যটি হলো ক্রসটেড অথবা নরওয়্যেজেন স্ক্যাবিস।
স্ক্যাবিসের লক্ষণ সমূহ
স্ক্যাবিস এর প্রধান লক্ষণ হল চুলকানি, সাধারণত এই চুলকানিটা রাতের বেলায় বেশি দেখা যায় আক্রান্ত রোগীর শরীর এত পরিমানে চুলকায় যে দেখা যায় রোগী চুলকাতে চুলকাতে গা দিয়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। স্ক্যাবিস হলে অসহনীয় চুলকানি হয়, যা সাধারণ চুলকানির মত নয়।শরীরের বিশেষ কিছু জায়গায় এই রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।
যেমন, আঙ্গুলের চিপায় বা ফাঁকে,হাতের তলুতে, কব্জিতে ও কনুইতে, বগলে এবং নাভির চারপাশে এই রোগটি অর্থাৎ স্ক্যাবিস দেখা যায়। এছাড়া লজ্জাস্থানে , স্তনে, নিতম্বে ও যৌনাঙ্গে স্ক্যাবিস রোগটির কারনে প্রচুর চুলকানি হয়ে থাকে। তবে সাধারণত মুখে এবং মাথায় স্ক্যাবিস এর লক্ষণ দেখা যায় না। কিন্তু শিশুদের ক্ষেত্রে স্ক্যাবিস মুখে এবং মাথায়ও হতে পারে।
শরীরে যে সকল জায়গা গুলো স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়, সেই সকল জায়গা গুলিতে প্রথমে ছোট ছোট ফুসকুড়ি উঠে এবং সেই জায়গাগুলোতে প্রচুর চুলকায় পরে সেই ফুসকুড়ি থেকে পানির মত তরল বের হয়। প্রচুর চুলকানোর কারনে ঐ সমস্ত ফুসকুড়ি গুলো থেকে পরে ঘা হতে দেখা যায়, এই ঘা কেই মূলত পাঁচড়া বলা হয়ে থাকে।
যে সব এলাকায় স্ক্যবিস বেশি দেখা যায়
সাধারণত গ্রাম এলাকায় স্ক্যাবিস রোগটি বেশি দেখা যায়। এছাড়া হল হোস্টেল, মাদ্রাসা,বস্তিতে এ রোগের দেখা মিলে। ঘনবসতি এলাকা গুলোতে এই রোগ বেশি দেখা যায় এবং ছড়ায়। কারণ এটি একটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ। তাই একজনের হলে ধীরে ধীরে প্রায় সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও বন্যা কবলিত এলাকা গুলিতে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মত জায়গায় এই রোগটি বেশি লক্ষণীয়।
এর মূল কারণ হচ্ছে এইসব জায়গায় বা ঘনবসতি এলাকাগুলিতে মানুষের বসবাস বেশি। একজনার ব্যবহার করা জিনিসপত্র আর একজন ব্যবহার করে। ঢালাও বিছানা করে শুয়ে থাকার কারণে একে অপরের সাথে স্পর্শ হয় বেশি। আর এই স্ক্যাবিস রোগটি মূলত স্পর্শের কারণেই আক্রান্ত ব্যক্তি হতে অন্য ব্যক্তিতে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে।
যেভাবে স্ক্যাবিস রোগটি ছড়ায়
একজন স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর থেকে আর একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে এই রোগটি ছড়ায়। স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসলে বা ওই রোগীর ব্যবহৃত কোন জিনিস যেমন গামছা, তোয়ালা বা জামাকাপড় ব্যবহার করলে আর একজন সুস্থ মানুষের শরীরে স্ক্যাবিস ছড়িয়ে পড়ে। স্কিন টু স্কিন কন্টাক্ট এর মাধ্যমে এই রোগটি ছড়ায়।
স্ক্যাবিস মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ হওয়ার কারণে,স্ক্যাবিসে আক্রান্ত ব্যক্তি যে জিনিসগুলো ব্যবহার করে সে সমস্ত জিনিস ব্যবহারের মাধ্যমে আর একজনের শরীরের মধ্যে স্ক্যাবিস রোগটি ঢুকে পড়ে খুব সহজেই। ধরুন একজন স্ক্যাবিসে আক্রান্ত ব্যাক্তি একটি চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ পর উঠে গেলো এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন সুস্থ স্বাভাবিক ব্যাক্তি ঐ চেয়ারে বসলো। এই জন্য ঐ সুস্থ ব্যাক্তির ও স্ক্যাবিস হতে পারে।
চেয়ারে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত ব্যাক্তি বসার কারনে ঐ চেয়ারে পোকাগুলির মধ্যে দুই একটা থেকে যেতে পারে এবং ঐ পোকাটি সুস্থ ব্যাক্তি বা আর একটা হিউম্যান বডি পেয়ে তার ত্বকের ভিতর প্রবেশ করে ডিম পাড়বে এবং আস্তে আস্তে (চার থেকে ছয় স্পতাহের ভিতরে) স্ক্যাবিস রোগটি ছড়িয়ে দিবে।
তবে স্ক্যাবিস রোগটি সবচেয়ে বেশি ছড়ায় পোশাক, বিছানার চাদর মানে কাপড় জাতীয় জিনিস থেকে এবং স্পর্শ (স্কিন টু স্কিন) থেকে।
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হয়ার পর ডাক্তারের সাথে পরামর্শ
স্ক্যাবিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর জন্য সবচেয়ে জরুরী একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাধারন ডাক্তার কে দেখানো এবং তার পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নেওয়া।আমাদের দেশে সাধারণত দেখা যায়, স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হওয়ার পর রোগী নিজেই ইউটিউব দেখে বা ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে নিজেই নিজের চিকিৎসা শুরু করে দেয়। এটাই হোল সবচেয়ে বড় ভুল।
আরো পড়ুনঃ বিনা পুঁজিতে লাভজনক ব্যাবসা
কারণ রোগীর কি ধরনের স্ক্যাবিস হয়েছে এবং তার কি কি শারীরিক সম্যসা আছে তার ওপর নির্ভর করে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।একেক জনের একেক ধরনের সমস্যা হতে পারে তাই ওষুধের ডোজ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। যদিও স্ক্যাবিসের চিকিৎসা প্রায় একি রকম। তারপর ও ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা অতি অবশ্যক।
স্ক্যাবিস থেকে মুক্তি পেতে যা যা করণীয়
স্ক্যাবিস রোগ থেকে মুক্তি পেতে সর্ব প্রথম যা করনীয় তা হোল ওষুধ সেবন করা এবং কিছু নিয়ম মেনে চলা। শুধুমাত্র ওষুধের মাধ্যমে এই রোগ সারানো সম্ভব না। মনে রাখতে হবে স্ক্যাবিস বাংলাদেশে খুব কমন একটা অসুখ এবং এর চিকিৎসা সাধারণ হোলেও এই রোগটি পুরোপুরি সেরে উঠতে অনেক সময় লেগে যায় যদি নিয়ম মেনে না চলা হয়। নিয়মানুবর্তিতাই এই রোগের প্রধান চিকিৎসা।
স্ক্যাবিস রোগের চিকিৎসা হিসাবে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে, মূলত পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম বা লোশন এবং এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ চুলকানি কমানোর জন্য। এছাড়া রোগের উপর নির্ভর করে এন্টিবায়োটিক, আইভারমেক্টিন গ্রুপের ওষুধ এবং কিছু ওয়েন্টমেন্ট বা ক্রিম ব্যাবহার করা হয়ে থাকে। রোগের প্রকোপ খুব বেশি হলে চুলকানি কমানোর জন্য প্রথমে ইনজেকশন ও ব্যবহার করা হয়ে থাকে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী।
স্ক্যাবিস রোগে ওষুধ ব্যাবহারের নিয়ম
স্ক্যাবিস রোগে আক্রান্ত রোগীকে প্রথমে সাবান দিয়ে ভালো ভাবে গা ঘুষে পরিস্কার করে গোসল করে নিতে হবে। তারপর গা শুকিয়ে পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম (স্ক্যাবেক্স/স্ক্যারিন) বা এই জাতীয় কিছু লোশান খুব ভালো ভাবে গলা থেকে একদম পা এর পাতা পর্যন্ত, শুধু মুখ এবং মাথা বাদ দিয়ে, পুরা শরীরে মালিশ করতে হবে।এরপর ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা শরীরে ক্রিম টি রেখে তারপর সাবান দিয়ে ভালোভাবে পুরা শরীর পরিষ্কার করে গোসল করে নিতে হবে।
ক্রিম মাখার সময় খেয়াল রাখতে হবে শরীরের কোন অংশ যেন বাদ না যায় শুধু মুখ, চোখ আর মাথা ছাড়া। চোখের ভিতর ক্রিমটি গেলে প্রচুর পরিমানে জ্বলবে আর মুখের ভিতর গেলে পেট খারাপ হতে পারে। তাই ক্রিম মাখার সময় এই বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে। বাচ্চাদের যেহেতু মুখে এবং মাথায় ও স্ক্যাবিস হয় তায় সে ক্ষেত্রে মুখে এবং মাথায় ও ক্রিমটি মাখা যেতে পারে। তবে খুব সতর্কতার সাথে মাখতে হবে, কোন ভাবেই যাতে চোখে ক্রিমটি না লাগে।
সাত দিন পরে পুনরায় ক্রিমটি ঠিক একই নিয়মে ব্যাবহার করতে হতে পারে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ি। রোগের প্রকোপ বা ধরন ভেদে ডাক্তার ক্রিমটি পাচ দিন অথবা সাত দিন পরে আবার কাউকে কাউকে স্পতাহে পরপর দুই থেকে চার দিন মাখতে বলে থাকেন। কাউকে আবার একই নিয়মে চার সপ্তাহ মাখতে বলেন, এটা নির্ভর করে স্ক্যাবিস রোগের মাত্রাটা কার শরীরে কত টুকু ছড়িয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে।
এন্টি হিস্টামিন জাতীয় ওষুধ (রিজ ১০ মি.গ্রা./এলসেট ৫ মি.গ্রা.) ব্যাবহার করা হয়ে থাকে ইচিং বা চুলকানি কমানোর জন্য।কাউকে আবার ডাক্তার ফেকক্সো ১২০ বা ফেনাডিন ১২০ ও দিয়ে থাকেন।
রোগের মাত্রা বেশি হলে আইভারম্যাক্টিন গ্রুপের ওষুধ (স্ক্যাবো,এলাইস ৬/১২ মি.গ্রা।) ব্যবহার করতে হয় রোগীর ওজন অনুযায়ি এবং অবশ্যই তা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী। চুলকিয়ে ঘা হয়ে যদি ইনফেকশন হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যাবহার করতে হয়।
স্ক্যাবিস খোসপাঁচড়া রোগ প্রতিরোধ
স্ক্যাবিস প্রতিরোধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং নিয়মানুবর্তিতা। শুধু ওষুধের উপর নির্ভর করে এই রোগটি কখনোই সম্পূর্ণরূপে ভালো করা সম্ভব না। এর জন্য দরকার পরিস্কার পছন্নতা বজায় রাখা।মনে রাখতে হবে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর পরিধানের কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে সাবান দিয়ে খুব ভালভাবে কেঁচে কড়া রোদে শুকাতে হবে ।প্রয়জনে ইস্ত্রি করে পরিধানের কাপড়গুলো ব্যবহার করতে হবে।
এছাড়াও রোগীর বিছানার চাদর বালিশের কাভার নিয়মিত গরম পানি দিয়ে ভিজেয়ে রেখে সাবান দিয়ে ভালো ভাবে কেঁচে রোদে শুকাতে হবে।গরম পানি আর কড়া রোদ, মূলত তাপের কারনে অনেকটাই স্ক্যাবিস (জিবানু) মুক্ত হয়। এই জন্যই ডাক্তাররা ইস্ত্রি করে কাপড় পরিধান করতে নির্দেশ দিয়ে থাকেন।
তাপের দ্বারা স্ক্যাবিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
স্ক্যাবিসের জীবাণু কোনো হিউম্যান বডি না পেলে কাপড়ে এরা সাধারণত তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তাই পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে যে,স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগীর ব্যবহার করা কাপড় ভালো করে ধোয়ার পরে এগুলো একটি পোটলাতে করে বেধে তিন থেকে চার দিন ঘরের কোথাও ফেলে রাখতে। তারপর সেই কাপড়গুলো ব্যাবহার করলে শরীরে পুনরায় স্ক্যাবিস রোগটি আসার সম্ভাবনা থাকে না।
মূলকথা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, নিয়মানুবর্তিতা এবং কিছু নিয়ম মেনে চললে এই রোগটি খুব সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। অন্যথায় স্ক্যাবিস রোগটি দীর্ঘ সময় ধরে রোগীকে ভোগাই। খুব সহজে রোগীর শরীর থেকে যেতে চাই না স্ক্যাবিস, গেলেও পুনরায় ফিরে আসে এই রোগটি। যদি না নিয়ম মেনে না চলে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত রোগী।
শেষ কথা
স্ক্যাবিস একটি মারাত্বক ছোঁয়াচে রোগ তাই এই রোগ হলে খুব দ্রুত চিকিৎসা করতে হবে। আক্রান্ত ব্যাক্তিকে চিকিৎসা, সেবা এবং সহযোগিতা করার মাধ্যমে রোগটি নিরাময়ের চেষ্টা করতে হবে।
মনে রাখবেন রোগকে ঘৃণা করলেও রোগীকে কখনো ঘৃণা করা যাবেনা।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url